দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে হবে : ড. কাজী খলীকুজ্জমান

কিউকে আহমদ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান উন্নয়ন চিন্তাবিদ ও পরিবেশকর্মী ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেছেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ করেছি। আমরা অন্যায় অত্যাচার, শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি। সেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যদি ধারণ করতে পারি তাহলে এখানে একটি সুন্দর সমাজ গড়ে উঠবে। যে সমাজে সবাই সম্মান ও মর্যাদা নিয়ে বসবাস করবে। পবিত্র সংবিধানে আছে সমাজে কোনো বৈষম্য থাকবে না, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। মানুষ মানবের মর্যাদায় বসবাস করবে। শ্রেণিবিভাজিত সমাজে একটি হবে নিচুতলা, একটি মধ্যমতলা একটি উঁচুতলা-এটা কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে যায় না।
মঙ্গলবার (২৭ সেপ্টেম্বর) জেলাশহরের নবাবগঞ্জ ক্লাব মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত ‘মূল্যবোধ, নৈতিকতা, পরার্থপরতা ও দেশপ্রেমে তরুণ সমাজকে উদ্বুদ্ধকরণ শীর্ষক সম্মেলন-২০২২’ এ প্রধান অতিথির বক্তৃতায় তিনি এসব কথা বলেন।
পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ)’র চেয়ারম্যান ড. খলীকুজ্জমান আরো বলেন, আমার মধ্যে যদি নীতি নৈতিকতা থাকে মুক্তিযুদ্ধের চেনতায় যদি বিশ্বাসস করি তাহলে আমরা অবশ্যই সফল হব। আমি বিশ্বাস করি আজকে যে কাজটা শুরু করলাম আগামীতে তা বিস্তার লাভ করবে এবং ভবিষৎ প্রজন্ম একটা উন্নত সম্পন্ন প্রজন্ম পাবে। এখানে যে তরুণ প্রজন্ম আছে তাদের থেকেও আরো উন্নত হবে, আগামীর দেশটা হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার।
বঙ্গবন্ধুর উদ্ধৃতি দিয়ে ড. খলীকুজ্জমান বলেন- দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে হবে। একটি মাত্র সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বঙ্গবন্ধু তেমনটাই চেয়েছিলেন। তিনি বলেন-উন্নয়ন প্রকল্পে পিছিয়ে পড়া বা পিছিয়ে থাকা মানুষগুলোকে প্রাধন্য দিতে হবে। এটাই ছিল মানুষকে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর চিন্তাচেতনা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তিনি একটি কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করছেন।
কাজী খলীকুজ্জমান বলেন- প্রতিষ্ঠান তাদের কাজের মধ্যে মানবিকতার দিকটা গুরুত্ব দেয় তাদের সাথে আমরা ‘মূল্যবোধ, নৈতিকতা, পরার্থপরতা ও দেশপ্রেমে তরুণ সমাজকে উদ্বুদ্ধ করতে কাজ কারছি। প্রয়াস মানবিক উন্নয়ন সোসাইটি এমনি একটি প্রতিষ্ঠান তাই আমরা প্রয়াসের কাজ শুরু করেছি। তিনি বলেন-প্রয়াসের নির্বাহী পরিচালক হাসিব হোসেনের যে দক্ষতা, চিন্তাভাবনা কর্মপ্রয়াস তারযে মানুষকে নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার চিন্তা সেটার জন্যেই আমরা আজকে এখানে এসেছি।
ড. খলীকুজ্জমান বলেন-আমাদের সমাজটাকে যদি সুস্থ করতে হয় তাহলে আমাদের পারিবারিক বন্ধনটা খুব জরুরি। একটা সময় ছিল যখন পরিবারের সবাই মিলে একসাথে বসবাস করতাম। কেউ একটু অসুবিধায় পড়লে কেউ না কেউ তাকে সহায়তা করতো। এখন সেটা ভেঙে গেছে গ্রামের তুলনায় শহরে এটা বেশি। আমাদের মধ্যে মূল্যেবোধের অবক্ষয়টা ব্যাপাক আকার ধারণ করেছে। সেখান থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। আমরা এমন একটা সমাজ চাই যে সমাজে সব মানুষ তার নিজের অধিকার নিয়ে বাঁচবে। সব মানুষ একই মর্যাদায় বসবাস করতে পারবে।
দারিদ্র্য বিমোচনে অবদানের জন্য ২০০৯ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক একুশে পদকে ভূষিত ড. কাজী খলীকুজ্জমান সম্মেলনে বলেন, আমি সৎ পথে এগিয়ে সততার সঙ্গে কাজ করব। অন্যকে হেয় করবনা, কারো কোন ক্ষতি করবো না। এই বিষয়গুলো যদি আমরা সবাই মেনে চলতে পারি এবং সেভাবে যদি আচরণ করতে পারি তাহলে বাংলাদেশ পরিবর্তন হয়ে যাবে। আমরা যদি মনে করি আমরা সবাই মানুষ, আমার জন্মগত অধিকার যেগুলি আছে সেগুলি আমি মানবো। আমি আমারটা পাওয়ার চেষ্টা করব কিন্তু অন্য কারো ক্ষতি করবনা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও সামাজিক দায়বদ্ধতা তহবিলের অর্থায়নে এবং প্রয়াস মানবিক উন্নয়ন সোসাইটির ব্যবস্থাপনায় এবং কিউকে আহমদ ফাউন্ডেশনের বাস্তবায়নে সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়।
সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন জেলা প্রশাসক এ কে এম গালিভ খাঁন। এতে বিশেষ অতিথি ছিলেনÑ পিকেএসএফের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য ড. মো. আবদুল মুঈদ ও অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মো. জসীম উদ্দিন, নবাবগঞ্জ সরকারি কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ প্রফেসর সুলতানা রাজিয়া এবং কিউকে আহমদ ফাউন্ডেশনের কোষাধ্যক্ষ তরফদার মো. আরিফুর রহমান। এছাড়াও ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিকসের প্রতিষ্ঠাতা ড. কাজী খলীকুজ্জমানের স্ত্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক ড. জাহেদা আহমদ ও অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট দেবেন্দ্র নাথ উরাঁও মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন।
সভাপতির বক্তব্যে জেলা প্রশাসক এ কে এম গালিভ খাঁন বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মানুষকে সম্মান করার কথাটা বলেছেন। আমরা যে কাজই করি সম্মান প্রত্যেকের প্রাপ্য। তিনি বলেন এখানে দেখলাম শিক্ষার্থীরা যে দেয়ালিকা করেছে তা অত্যন্ত চমৎকার। তাদের নিজেদের মধ্যেকার ভাবনা তারা প্রকাশ করেছে। এটির মধ্যে দিয়ে তাদের যে চিন্তা ভাবনা তা আগামীতে বাংলাদেশের একটি বড় ভিত্তি হবে বলে আমি মনে করি। জেলা প্রশাসক বলেন, আমারা চাই একটি সমৃদ্ধ আলোকিত বাংলাদেশ এবং সর্বোপরি আলোকিত বিশ্ব। এই ছেলেমেয়েদের মধ্যে আমি সেই আলোর ছটা দেখতে পাচ্ছি। সেই আলোকিত বাংলাদেশ এবং বিশ্বের প্রত্যাশা করেন জেলা প্রশাসক।
স্বাগত বক্তব্যে প্রয়াসের নির্বাহী পরিচালক হাসিব হোসেন বলেন, আমরা সম্মেলন করে থাকি সমাজের বিভিন্ন মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য, আমরা চাঁপাইনবাবগঞ্জে জন্ম নেয়া সন্তান। প্রয়াসও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে চাঁপাইনবাবগঞ্জেরই একটি সন্তান। তিনি বলেন আমরা তরুণদেরকে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি এই সম্মেলনের মধ্যে দিয়ে।
হাসিব হোসেন বলেন মানুষ কখনো পিছিয়ে যায়না। যতই বাধা থাকুক মানুষ সামনে দিকে এগিয়ে যাবে। তিনি আরো বলেন, ভালো উদ্যোগের সাথে প্রয়াস মানবিক উন্নয়ন সোসাইটি আছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের মানুষকে প্রয়াস কিউকে আহমদ ফাউন্ডেশনের সাথে কাজ করার সুযোগ করে দিচ্ছে এটা আমাদের কাছে গর্বের জায়গা। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশে প্রথম ১০টি উপজেলায় এই কার্যক্রমটা হচ্ছে তার মধ্যে থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জকে বেছে নিয়েছে। এটা চাঁপাইনবাবগঞ্জের জন্য একটি ভালো লাগার জায়গা। আমরা চাই চাঁপাইনবাবগঞ্জ বাংলাদেশে বিভিন্নভাবে নেতৃত্ব দিক।
হাসিব হোসেন বলেন আমাদের সামনে যে তরুণরা আছে তারা আগামী দিনকে নিশ্চয় উজ্জ্বল করবে। অবশ্যই সেটা মূল্যবোধ, নৈতিকা, পরার্থপরতা ও দেশপ্রেমের মধ্যে দিয়ে এবং সেখানে তারা জয় করবে, কর্মের মধ্যে দিয়ে। আগামী দিনকে আমরা নিশ্চয় দেশের জন্য নিবেদিত করব।
সকাল ৯ টা থেকে সম্মেলনে অংশগ্রহণের জন্য শুরু হয় নিবন্ধন। এরপর শিক্ষার্থীদের মধ্যে কুইজ প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রথম হন নবাবগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ের নাফিম ইকবাল, দ্বিতীয় হন একই বিদ্যালয়ের মুসতাকিম আহমেদ এবং তৃতীয় হন বালিয়াডাঙ্গা ফাজিল মাদ্রাসার মোহাম্মদ আলী। দেয়ালিকা প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছে নামোশংকরবাটী উচ্চ বিদ্যালয়, দ্বিতীয় চাঁপাইনবাবগঞ্জ কামিল মাদ্রাসা এবং তৃতীয় হয়েছে বালিয়াডাঙ্গা ডিএস ফাজিল মাদ্রাসা। এছাড়া বই আলোচনা প্রতিযোগিতায় প্রথম হন এক্সিম ব্যাংক কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কামরুন নাহার হাসান, দ্বিতীয় হন নবাবগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ের শ্রী ভৈরব কুমার ঘোষ এবং তৃতীয় হন পলশা উচ্চ বিদ্যালয়ের সুমাইয়া খাতুন।
সম্মেলনে অতিথিদের বক্তব্যের আগে পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন তুলে ধরেন প্রয়াসের কর্মসূচি ব্যবস্থাপক (প্রশিক্ষণ) আব্দুস সালাম। এরপর অনুভূতি ব্যক্ত করেন শিক্ষার্থীদের মধ্যে থেকে আলীনগর উচ্চ বিদ্যালয়ের ৭ম শ্রেণির শিক্ষার্থী তৌফিকুর রহমান সিফাত ও কামাল উদ্দিন উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের ১০ম শ্রেণির শিক্ষার্থী ফৌজিয়া ফেরদৌস; অভিভাবকদের মধ্যে থেকে তরিকুল ইসলাম ও হবিউর রহমান এবং শিক্ষকদের মধ্যে থেকে লক্ষ্মীপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আশরাফুল ইসলাম, বালিয়াডাঙ্গা ফাজিল মাদ্রাসার সহকারী শিক্ষক মেরী জিন্নাত ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ কামিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ড. এমরান হোসেন।
সম্মেলন শেষে প্রতিযোগিতার বিজয়ীদের মধ্যে পুরস্কার বিতরণ করেন অতিথিবৃন্দ।
সম্মেলন শেষে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির টানা তিনবারের সাবেক নির্বাচিত সভাপতি ড. কাজী খলীকুজ্জমান নাচোল উপজেলার নেজামপুর ইউনিয়নের আলপনা গ্রাম পরিদর্শন করেন। বিকেলে আলপনা গ্রামে পৌঁছলে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সদস্যরা তাদের নিজস্ব রীতিতে ড. খলীকুজ্জমানসহ অন্য অতিথিদের বরণ করে নেয়। এরপর ড. খলীকুজ্জমান আলপনাসমৃদ্ধ দেখন বর্মনের বাড়িটি ঘুরে দেখেন। এ সময় দেখন বর্মনের বাড়ির আলপনা দেখে মুগ্ধ হন অতিথিবৃন্দ। অতিথিবৃন্দ সেখানে মন্তব্য বইয়ে স্বাক্ষর করেন।
দেখন বর্মনের বাড়ি থেকে বের হওয়ার পথে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সদস্যরা সমাজসেবায় স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত ড. কাজী খলীকুজ্জমানের কাছে তাদের দাবি-দাওয়া তুলে ধরেন। তাদের দাবি শুনে তা বাস্তবায়নের আশ্বাস দেন তিনি।
২০০৭ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ইন্টারগভর্নমেন্ট প্যানেল অব ক্লাইমেট চেঞ্জের সদস্য ড. খলীকুজ্জমান এরপর প্রয়াসের প্রবীণ জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় নেজামপুর ইউনিয়নের একটি ‘সোনালী টি স্টল’ পরিদর্শন করেন। সেখান থেকে তিনি সদর উপজেলার গোবরাতলা ইউনিয়নে পলশায় পেস প্রকল্পের আওতাধীন বিভিন্ন কার্যক্রম ঘুরে দেখেন। সন্ধ্যার পর প্রয়াস ফোক থিয়েটার ইনস্টিটিউটের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে শেষে ড. খলীকুজ্জমান রেডিও মহানন্দার লাইভ অনুষ্ঠান ‘কাছে থেকো বন্ধু’তে সস্ত্রীক যুক্ত হন।