শাহরিয়ার শিমুল
চাঁপাইনবাবগঞ্জের উন্নয়নে ভূমিকা রেখে চলা প্রয়াস মানবিক উন্নয়ন সোসাইটি দেখতে দেখতেই সফলতার ২৯ বছর পার করে ফেলল। অথচ বর্তমান প্রধান কার্যালয়ের নিচতলায় বারান্দা লাগোয়া একটি ছোট ঘরেই শুরু হয়েছিল এর পথচলা। এখন পরিসরও বেড়েছে। ইউনিট অফিসও হয়েছে অনেক। চাঁপাইনবাবগঞ্জের গ-ি ছাড়িয়ে দেশের অন্য জেলাগুলোতেও প্রান্তিক ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার জনগোষ্ঠীর ইস্যুভিত্তিক উন্নয়নে নিরলস কাজ করে চলেছে প্রতিষ্ঠানটি।
১৯৯৩ সালের ১৯ ডিসেম্বর পথচলা শুরু করা প্রয়াস প্রায় ৩ বছর ওই ছোট ঘরেই বসে কার্যক্রম চালিয়ে গেছে। শুরুর কয়েকটা বছর জনবল ছাড়াই একাই প্রয়াসকে টেনে নিয়ে গিয়েছেন এর প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক হাসিব হোসেন।
এরপর ধীরে ধীরে পরিসর বড় হয় প্রয়াসের। কর্মপরিসর বাড়াতে প্রয়োজন হয় ইউনিট/শাখা অফিস খোলার। আজ চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ সারা দেশের রাজশাহী, নাটোর, নওগাঁ, জয়পুরহাট, বগুড়া ও গাইবান্ধা জেলায় প্রয়াসের ৭১টি ইউনিট অফিস সেসব এলাকার প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে ভূমিকা রেখে চলেছে।
১৯৯৭ সালের ৩ জানুয়ারি চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার গোবরাতলা ইউনিয়নে কাজ করার লক্ষে প্রথম ইউনিট অফিস খোলা হয়। ইউনিট অফিসটির অবস্থান গোবরাতলা ইউনিয়নের চাঁপাই গ্রামে (বালিয়াডাঙ্গা ইউনিয়নের সীমান্ত ঘেঁষা)। প্রথম দিকে টিনের ছাপড়া ঘরে শুরু হয়েছিল ইউনিট অফিসটির কার্যক্রম। আজ সেখানে প্রায় সাড়ে চার বিঘা জায়গার ওপর কার্যক্রম পরিচালনা করছে ইউনিট অফিসটি।
প্রয়াসের বিশাল কর্মযজ্ঞ পরিচালিত হয় এই ইউনিট অফিসের মাধ্যমেই। আর এই ইউনিটটির প্রতি ভালো লাগা অনুভূতি সবসময় বিরাজমান নির্বাহী পরিচালক হাসিব হোসেনের মনে, যা তার কথাবার্তাতেও ফুটে উঠে।
জনবলের জন্য প্রথম নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয় ১৯৯৬ সালে। গোবরাতলা ইউনিট অফিসের জন্য প্রথম নিয়োগ পেয়েছিলেন মুনিরা খাতুন ও শিমন মারান্ডী। পরে আরো কয়েকজনকে নিয়োগ দেয়া হয়। এদের মধ্যে শ্যামল সরেন, হালিমা খাতুন, অলোকা রানী উল্লেখযোগ্য। প্রথম নিয়োগ পাওয়া মুনিরা খাতুন বর্তমানে প্রয়াসের নির্বাহী কমিটির সদস্য এবং অলোকা রানী ডেপুটি ম্যানেজার (নিরীক্ষা) পদে কর্মরত রয়েছেন।
গোবরাতলা ইউনিট অফিস সামাজিক কার্যক্রম দিয়েই শুরু হয়। সামাজিক কার্যক্রমের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলÑ বয়স্ক শিক্ষার নাইট স্কুল, স্যানিটেশন, এনএফপিই স্কুল (নন-ফরমাল প্রাইমারি এডুকেশন) পরিচালনা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ, বিশুদ্ধ খাবার পানি, আর্সেনিক পানি ও আয়োডিনযুক্ত লবণ সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি।
গোবরাতলা ইউনিট অফিস অল্প পুঁজি দিয়ে কার্যক্রম শুরু করেছিল। এই ইউনিট অফিসের প্রথম সদস্য হয়েছিলেন জমিলা বেগম, এখনো সদস্য আছেন। বর্তমানে এই ইউনিটের সদস্য প্রায় ২ হাজার।
তবে প্রয়াস মানবিক উন্নয়ন সোসাইটির বিশাল কর্মযজ্ঞ সাধিত হয় এই প্রথম ইউনিট অফিসের মাধ্যমেই। এই গোবরাতলা ইউনিট অফিসেই রয়েছে প্রয়াসের সহযোগী প্রতিষ্ঠান রেডিও মহানন্দা ৯৮.৮ এফএমের ট্রান্সমিশন স্টেশন। এছাড়া এখান থেকেই প্রতিদিন সাধারণ মানুষকে স্বাস্থ্য সেবা দেয়া হচ্ছে।
ইউনিট অফিস লাগোয়া জমিতেই গড়ে উঠেছে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের জন্য ড্রাই ম্যাংগো কারখানা। এখানেই রয়েছে প্রয়াস নার্সারি, কুচিয়ার ব্রিডিং ডিচ, ভার্মি কম্পোস্ট কারখানা। আরো রয়েছে প্রয়াস ফোক থিয়েটার ইনস্টিটিউট (পিএফটিআই) এর স্টুডিও থিয়েটার। এই ইউনিটের আওতায় আমারকে গড়ে উঠেছে পুকুরে মুক্তা চাষ, ভেড়ার ব্রিডিং ও টার্কির প্যারেন্টস্টক খামার, পাতিহাঁস ও রাজহাঁসের খামার, যেখানে রয়েছে বিভিন্ন জাতের ভেড়া যেমন গাড়ল, অস্ট্রেলিয়ান হোয়াইটসিফ, ব্ল্যাক হেড ডরপার এবং পার্সিয়ান হার্লিকুইন্স ও আওয়াসি দুম্বা। এই আমারকেই ১৫ বিঘা জমিতে রয়েছে ড্রাগন-থাই, কাটিমন আম ও মাল্টা-গৌড়মতি আমের মিশ্র ফলের বাগান।
ইউনিটটির মাধ্যমে হাজার হাজার পরিবারকে এসএমই ও ক্ষুদ্র ঋণ প্রদানের পাশাপাশি সামাজিক ইস্যুভিত্তিক কার্যক্রম, যেমনÑ পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ, নারীর ক্ষমতায়ন, ওয়াটার অ্যান্ড স্যানিটেশন, মানবপাচার প্রতিরোধ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং বিভিন্ন অধিকারভিত্তিক কার্যক্রম বাস্তবায়িত হয়। এছাড়া কৃষি, প্রাণিসম্পদ ও মৎস্য এর বিভিন্ন আধুনিক নতুন নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এখানে ব্যাপক কর্মসূচি পরিচালনা করছে প্রয়াস।